ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতার জন্য বক্তার মধ্যে কী কী গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক?

ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতার জন্য বক্তার মধ্যে কী কী গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক?

ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতার জন্য বক্তার মধ্যে কী কী গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক?

(বক্তা, শ্রোতা এবং মাহফিলের আয়োজক সকলের জানা জরুরি)

 ▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

ওয়াজ মাহফিলে বক্তা নির্বাচন ও বক্তৃতার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। এ ক্ষেত্রে চলছে চরম দুরাবস্থা ও ভয়াবহ শরিয়ত বহির্ভূত কার্যক্রম। তাই এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মুসলিমদের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। 

কারণ— আমাদের অজানা নয় যে, বর্তমান সময়ে কারও চাপার জোর, সুললিত কণ্ঠ, হাসানো, কাঁদানো, কৌতুক, ড্যান্স, অভিনয়, গান-গজল,  ইত্যাদি দ্বারা মাহফিল জমানোর মত কৌশল, উস্কানি ও হুংকার মার্কা কথাবার্তা দিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করার মত যোগ্যতা থাকলেই তিনি বিশাল বক্তা ও আন্তর্জাতিক মুফাসসিরে কুরআনে পরিণত হন। অনুরূপভাবে সার্টিফিকেট, পদবী, সুন্দর চেহারা, ইংরেজি বলার দক্ষতা থাকলে তিনি বিশাল আল্লামা! 

মাহফিলগুলোতে বিদেশ থেকে আগত, রেডিও-টিভির ভাষ্যকার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ২৬ ইঞ্চি বক্তা, শিশু বক্তা, নারী থেকে পুরুষের রূপান্তরিত হওয়া বক্তা, নওমুসলিম বক্তা ইত্যাদি নানা অদ্ভুত উপাধি ও বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বক্তার চাহিদা তুঙ্গে। যেন এগুলোই বক্তা নির্বাচনের মানদণ্ড! কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এগুলো আদৌ  শরয়ী মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে না। 


যার কারণে— বিশাল বিশাল ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে, সেগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হচ্ছে, এ উপলক্ষে জমজমাট প্রচার-প্রচারণা চলছে, এলাকার যুবকদের মাঝে মাহফিল নিয়ে অনেক উত্তেজনা কাজ করে, মাহফিল উপলক্ষে এলাকায় বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, এগুলো অধিকাংশই সামাজিক অনুষ্ঠান, বার্ষিক রুটিন ওয়ার্ক এবং অর্থ কালেকশনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ওয়াজ মাহফিল থেকে মানুষ প্রত্যাশিত উপকার লাভ করে না, সেগুলো থেকে হেদায়েতের আলো বিচ্ছুরিত হয় না এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সঠিক দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য পাওয়া যায় না। 


এর কারণ—অধিকাংশ ওয়াজ মাহফিল আয়োজন কারীদের নিয়ত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সঠিক নয়। ফলে তারা বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শরয়ী মানদণ্ড বিচার না করে মাহফিল জমানো ও আকর্ষণ সৃষ্টি করার মত বক্তা অনুসন্ধান করে। ফলশ্রুতিতে একশ্রেণীর তথাকথিত বাজারি ও পেশাদার বক্তা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে মানুষকে কিভাবে আকর্ষণ করে স্টেজ মাতানো যায় সেই চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে—যা খুবই দুর্ভাগ্য জনক এবং শরয়ী দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।

 

যাহোক, নিম্নে আমরা ইসলামি আইন বিষয়ক বিশ্বকোষ ‘আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ থেকে ওয়ায়েজ বা ধর্মীয় বক্তার মধ্যে কী কী শর্তাবলী এবং শিষ্টাচার থাকা কর্তব্য সেগুলো উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তওফিক দানকারী:


 ❑ ওয়াজ কারী বা বক্তার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যথা:


◈ এক. শরিয়তের বিধিবিধান আবশ্যিকভাবে অর্পিত হওয়ার মত উপযুক্ত হওয়া অর্থাৎ তিনি সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হবেন।

◈ দুই. ন্যায়-নীতি ও আদর্শবান হওয়া।

◈ তিন. মুহাদ্দিস হওয়া। অর্থাৎ তিনি হাদিস শাস্ত্রের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখবেন, হাদিস পাঠ করবেন, হাদিসের শব্দাবলীর অর্থ বুঝবেন এবং তার শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখবেন-যদিও তা কোনও বড় মুহাদ্দিস অথবা কোনও ফিকহবিদের গবেষণালব্ধ তথ্যাদির ভিত্তিতে হয়।


◈ চার. মুফাসসির হওয়া। অর্থাৎ তিনি কুরআনের দুর্বোধ্য ও কঠিন শব্দাবলীর অর্থ জানবেন এবং (বাহ্যত) সমস্যাপূর্ণ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধান জানবেন এবং সে সম্পর্কে পূর্বসূরি তাফসির কারকদের থেকে বর্ণিত তাফসির সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন।

 - পাশাপাশি তার জন্য এমন বাগ্মী ও সুভাষী হওয়া উত্তম যে, তিনি মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাইরে কথা বলবেন না। সেই সাথে তিনি হবেন নম্র, ভদ্র ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। 

 - তিনি দীনের বিষয়গুলোকে মানুষের সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করবেন; জটিলতা সৃষ্টি করবে না। [আবজাদুল উলুম ২/৫৩৬-প্রকাশনী: দারুল কুতুবুল ইলমিয়া]

 

 ❑ বক্তার কতিপয় শিষ্টাচার:

 

ওয়ায়েজ (বক্তা), আলেম এবং শিক্ষকের অন্যতম শিষ্টাচার হল, তিনি এমন সব কথাবার্তা, কার্যক্রম ও আচার-আচরণ পরিত্যাগ করবেন যা বাহ্যত ভুল মনে হয়- যদিও তিনি এ ক্ষেত্রে নির্ভুল হন। কারণ তিনি এমনটি করার কারণে (সাধারণ মানুষের মাঝে) বিভিন্ন সমস্যা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যেমন:

 

 ❂ কারও মধ্যে এমন বিষয় জানা গেলে অনেকেই ধারণা করে বসবে যে, এটা সর্বাবস্থায় জায়েজ। ফলে তা শরিয়তের বিধান বা আমল যোগ্য বিষয়ে পরিণত হবে- যে বিশেষ পরিস্থিতিতে তা করা হয়েছিলো তার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকবে না।

 ❂ বক্তা যদি নাজায়েজ কর্মে জড়িত হয় তাহলে মানুষ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, তার সমালোচনা করবে এবং তার থেকে দূরে সরে যাবে।

❂ মানুষ তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং মানুষকেও তার ব্যাপারে সাবধান করবে যেন তার থেকে কেউ ইলম গ্রহণ না করে। 

 ❂ তার সাক্ষ্য ও বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য হবে। তার দেওয়া ফতোয়ার আমল প্রত্যাখ্যাত হবে এবং তার ইলমি কথা-বার্তার ব্যাপারে মানুষের মন থেকে আস্থা চলে যাবে ইত্যাদি।


❑ ওয়াজ মাহফিলে অর্থ কালেকশন নাজায়েজ:


ফাতাওয়া হিন্দিয়াতে এসেছে, “বক্তার জন্য ওয়াজ মাহফিলে মানুষের কাছে কোনও কিছু চাওয়া জায়েজ নাই। কারণ তা ইলম এর মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জন।” [ফাতাওয়া হিন্দিয়াহ ৫/৩১৯’

[উৎস: আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যা বা কুয়েতি ফিকাহ বিশ্বকোষ, ৪৪/৮১-৮৩,অনলাইন ভার্সন-সংক্ষেপায়িত]

আল্লাহ তাআলা যেন, আমাদেরকে সবচেয়ে সঠিক ও সুন্দর পদ্ধতিতে আল্লাহর দীনের আহ্বানকে গণ মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার তাওফিক দান করেন আর আমরা যে সব হেদায়েতের কথা মানুষকে বলবো তা যেন কর্মে বাস্তবায়ন করতে পারি রাব্বুল আলামিনের নিকট সেই তাওফিক  কামনা করি।

 ▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬

Read Also :

Getting Info...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.